মমি তৈরির আদি কথা - মিশর নাকি চিলি?

ঐতিহাসিকরা বড্ড একপেশে! কেননা মিশরীয় সভ্যতারও ২০০০ বছর আগে পেরু-চিলির সীমান্ত অঞ্চলের চিচোরো জনজাতিদের মমি নিয়ে ওনারা উল্লেখযোগ্য আলোচনা কম করে থাকেন।







মমির কথা উঠলেই মনে আসে মিশরের দৃশ্য। আর তাই দক্ষিণ আমেরিকার একেবারে প্রান্ত দেশে পেরু এবং চিলির সীমান্ত অঞ্চল থেকে যখন একের পর এক মমি পাওয়া যাচ্ছিল, তখন সেদিকে দৃষ্টি দেননি অনেক ঐতিহাসিকই। মমি তৈরি প্রক্রিয়া একান্তই মিশরীয়দের আবিষ্কার, এমনটাই বিশ্বাস ছিল। কিন্তু গত এক শতাব্দী ধরে দক্ষিণ আমেরিকার  আরিকা এবং পারিনাকোটা অঞ্চলে মমি উদ্ধারের ঘটনা বাড়তেই থাকে।



কখনও নতুন বাড়ি তৈরি করতে গিয়ে মাটির নিচ থেকে পাওয়া যেত অদ্ভুত সব মৃতদেহ, কখনও আবার কোনো পোষ্য কুকুর হঠাৎ রাস্তার ধারে মাটি খুঁড়তে খুঁড়তে বের করে আনত দেহাংশ। এমনকি অনেক সময় শোনা যেত স্থানীয় বালক-বালিকারা মৃতদেহের মাথার খুলি নিয়ে ফুটবল খেলছে। প্রথমদিকে স্থানীয় মানুষদের কাছে বিষয়টা আতঙ্কের উদ্রেক করেছিল। কিন্তু ক্রমশ অভ্যস্ত হয়ে উঠেছিলেন তাঁরা। তবে ঐতিহাসিকদের পক্ষে আর নির্বিকার হয়ে থাকা সম্ভব হল না। আর এই সময়েই সমস্ত মমি সংরক্ষণের উদ্যোগ নিয়ে এগিয়ে এলেন দুই মহিলা। আনা মারিয়া নিয়েটো এবং পাওলো পিমেন্টাল। একটু একটু করে গবেষণা এগিয়েছে। দক্ষিণ আমেরিকার অতি প্রাচীন চিচোরো জনজাতির ইতিহাস আবিষ্কার করতে করতে চমকে উঠেছেন প্রত্নতাত্ত্বিকরাও। আর সম্প্রতি চিচোরো জনজাতির ইতিহাসের নিদর্শন হিসাবে আরিকা ও পারিনাকোটা অঞ্চলকে আন্তর্জাতিক ঐতিহ্যের স্বীকৃতি দিয়েছে খোদ ইউনেস্কো।





দক্ষিণ পেরু ও উত্তর চিলির সীমান্ত অঞ্চলে চিচোরো জনজাতির বসবাস শুরু হয় আনুমানিক ৭ হাজার বছর আগে। অর্থাৎ মিশরীয় সভ্যতার চেয়েও অন্তত ২ হাজার বছরের পুরনো চিচোরো সভ্যতা। আর এখানকার মমিদের বয়সও ততটাই প্রাচীন। তেমনই প্রাচীন মমি তৈরির পদ্ধতিও। তবে প্রায় সব মমিই মানুষ কৃত্রিমভাবে তৈরি করেছে, প্রকৃতির নিয়মে মৃতদেহ যেভাবে মমিতে পরিণত হয়, তেমনটা নয়। এমনটাই জানাচ্ছেন ঐতিহাসিকরা। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই মমির শরীরের মধ্যে কোনো অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ পাওয়া যায়নি। অনুমান করা হয়, পচনের হাত থেকে বাঁচাতে সেইসব অঙ্গ বের করে নেওয়া হত। তারপর সমুদ্রের জল আর রোদে শুকিয়ে ফেলা হত চামড়া। প্রায় পুড়ে যাওয়া চামড়ার ভিতরে বাঁশ-লাঠি দিয়ে তৈরি করা হত কাঠামো। অনেক ক্ষেত্রে অবশ্য হাড়গুলি দিয়েই কাঠামো অবিকৃত রাখার চেষ্টা করা হয়েছে। এরপর মাথায় কালো চুল এবং কাদা দিয়ে তৈরি মুখোশ পরিয়ে দেওয়া হত।






মিশরীয়দের চেয়ে চিচোরোদের মমি তৈরির পদ্ধতি যেমন আলাদা, তেমনই আলাদা ছিল রীতিনীতিও। মিশরে শুধু রাজপরিবারের সদস্য এবং অভিজাত মানুষদেরই মমি পাওয়া যায়। কিন্তু দক্ষিণ আমেরিকায় নারী-পুরুষ, শিশু এমনকি মৃত ভ্রূণের মমিও পাওয়া গিয়েছে। আর এইসমস্ত মমির ক্ষেত্রে সামাজিক পদমর্যাদার কোনো বিষয় ছিল না। চিচোরো সমাজও অনেক বেশি সাম্যবাদী ছিল বলেই অনুমান ঐতিহাসিকদের। এইসমস্ত মমি সেই নমুনাই বহন করে।


এখনও অবধি কয়েক হাজার মমি উদ্ধার করা হয়েছে আরিকা ও পারিনাকোটা অঞ্চলে। তার মধ্যে মাত্র ৩০০টি মমি মিউজিয়ামে জায়গা পেয়েছে। তবে সমস্ত মমিকেই এক জায়গায় এনে পৃথক একটি মিউজিয়াম তৈরির প্রয়োজন রয়েছে বলে মনে করছেন আনা মারিয়া নিয়েটো এবং পাওলো পিমেন্টেল। তবে তার জন্য বেশ কিছু অর্থের প্রয়োজন। ইউনেস্কো থেকে স্বীকৃতি পাওয়ার পর সেই কাজটাও অনেকটাই সহজ হবে বলে মনে করছেন তাঁরা।    

                                                                        

তথ্যসূত্রঃ  Living with the world's oldest mummies, 

Jane Chambers, BBC.


Post a Comment

Previous Post Next Post